জনৈক ব্যক্তি বিশ্বনবী (সা.) এর কাছে জানতে চাইলেন, মহান আল্লাহ মানুষকে অনেক কিছু দান করেছেন, এর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান দান কোনটি? বিশ্বনবী (সা.) বললেন, ‘সবচেয়ে মূল্যবান দান সুন্দর চরিত্র।’
বস্তুত মানুষকে নৈতিক দিক থেকে পবিত্র ও শুদ্ধ রাখার ব্যাপারে ইসলাম ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো জীবন ব্যবস্থাই এত বেশি গুরুত্বারোপ করেনি। মানুষের শান্তি সমৃদ্ধি ও আখেরাতের মুক্তির একমাত্র শর্ত হিসেবে উত্তম ও পবিত্র চরিত্রকে নির্ধারণ করে দিয়েছে ইসলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন গুণটির জন্য আখেরাতে মানুষ সবচেয়ে বেশি জান্নাতে যাবে? তিনি বলেন, হুসনুল খুলুক বা উত্তম চরিত্র।
মানবতার সামনে নীতি ও নৈতিকতার উন্নত আদর্শ হিসেবে আল্লাহ তাআলা নবী করিম (সা.)-কে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। উন্নত নৈতিকতা ও উত্তম আদর্শের প্রতীক হিসাবে আল্লাহর নবী যে আগমন করেছেন তা তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমাকে উন্নত নৈতিকতার মর্যাদা সহকারে প্রেরণ করা হযেছে।’ (ইবনে মাজা)
নৈতিকতা হলো নীতি থেকে অর্জিত জ্ঞান। নৈতিকতা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ভদ্রতা, সুন্দর চরিত্র, উত্তম আচরণ ইত্যাদি। মানব চরিত্রের প্রশংসনীয়, গ্রহণযোগ্য ও সর্বক্ষেত্রে সমাদৃত গুণাবলির সমন্বিত রূপটি হলো নৈতিকতা। সুতরাং নৈতিকতা বলতে আমরা বুঝি মানুষের সদাচরণ, সচ্চরিত্র, সততা ও নিষ্ঠার বহিঃপ্রকাশ। সচ্চরিত্রবান হওয়ার জন্য প্রিয় নবীজি (সা.) নানাভাবে উৎসাহ প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন,? উত্তম পথ, গাম্ভীর্যপূর্ণ উত্তম আচরণ এবং পরিমিতিবোধ নবুয়তের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো, মানুষের জ্ঞান, বিবেক-বিবেচনা ও প্রজ্ঞা আছে। মানুষের আরও আছে বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। যেটা অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে অনুপস্থিত। সামাজিক জীব হিসেবে একজন মানুষকে জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা নিয়মরীতি মেনে চলতে হয়। এ সব নিয়মরীতি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। সমাজ জীবনে মানুষের মার্জিত ও কাঙ্ক্ষিত আচরণগুলোকে নৈতিকতার ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেমন সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সুন্দর স্বভাব, সদাচার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কল্যাণকামিতা ইত্যাদি।
মানব জীবনে নৈতিকতার গুরুত্বটা কোথায়- এরকম প্রশ্ন মনে জাগতেই পারে। এর জবাব হলো মানুষের ভেতরে ভালো এবং মন্দের লড়াই নিরন্তর চলতে থাকে। মনের কামনা বাসনা চরিতার্থ করতে মন্দ শক্তি সবসময় চেষ্টা করে মানুষকে বিপথে টেনে নিতে। সে সময়নীতি নৈতিকতার চিন্তা শুভবোধ হয়ে সারাক্ষণ মন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে। এভাবেই নৈতিক গুণগুলো মানুষকে প্রবৃত্তির বিপরীত স্রোত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। মানুষকে কখনো বিপথগামী হতে দেখলে নৈতিকতা অশনি সংকেত হিসেবে সতর্ক করে তোলে। মূলত এই শক্তিশালী নৈতিকতাই হলো আল্লাহর প্রতি ইমান। কেবল এই ইমানই পারে মানব গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে এবং মানব অস্তিত্বের ওপর সমূহ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। অপরদিকে নৈতিকতার পূর্ণতা তখনই বিশ্বাসযোগ্যতা বা দৃঢ়তা লাভ করে যখন তা অর্জিত হয় আল্লাহর প্রতি দ্বন্দ্বহীন ইমানের ভিত্তিতে।
মানব জীবনের উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রধান নিয়ামক হলো এই নৈতিকতা। চারিত্রিক গুণাবলি ও নৈতিকতা হলো জাতিসত্তা স্বকীয়তা ও সভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষার চাবিকাঠি। কেননা, জাতির শক্তি সামর্থ্য তাদের বস্তুগত উপাদান ও বৈষয়িক বিষয়-আাশয় দ্বারা পূর্ণতা লাভ করে না, বরং উত্তম ও নৈতিক চরিত্রের মাধ্যমে তাদের পূর্ণতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা প্রমাণিত হয়। জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি রক্ষার ক্ষেত্রে নৈতিকতা একটি অপরিহার্য উপাদান। কোনো জাতি যখন অনৈতিকতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন তাদের বেঁচে থাকার শক্তি হারিয়ে যায়, তাদের পতন ত্বরান্বিত হয়। এক পর্যায়ে তাদের ওপর নেমে আসে বিভিন্ন বালা-মুসিবত, অভাব-অনটন, রোগব্যাধি, নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারি।
আল্লাহতায়ালা বলেন, যদি সেসব জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং আল্লাহকে ভয় করত, তবে আমি আসমান ও জমিনের কল্যাণগুলো তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতাম; কিন্তু তারা অস্বীকার করল। ফলে আমি তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিলাম।
একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা ও সুশৃঙ্খল জাতি গঠনের জন্য যে শিক্ষার প্রয়োজন, তার মূল কথাই হলো নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষার আবর্তনে আবর্তিত শিক্ষা আমাদের অহিংসা, মমতা, শ্রদ্ধাবোধ, সুন্দর কথা, সততা, উদারতা, শিষ্টাচার, শালীনতা, সৌজন্যমূলক আচরণ শিক্ষা দেয়। যে মানুষের মধ্যে নৈতিকতা বিকশিত হয় না, বরং বিপরীত দিকে পাশবিকতা, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ প্রাধান্য লাভ করে সে মানুষ এবং পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। এধরনের মানুষ দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক ও সর্বনাশের কারণ। এই শ্রেণির মানুষের আধিক্যতার কারণে গোটা সমাজ ব্যাবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। কেননা, এদের কাছে শুধু নিজের স্বার্থই মুখ্য বিষয়। তারা বৈধ ও অবৈধ, জায়েজ-নাজায়েজ, হালাল-হারামের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, আমি বহু জিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে, উপলব্ধি করে না, চোখ আছে, দেখে না, কান আছে, শুনে না- এরা হলো চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তার থেকেও নিকৃষ্ট। আর এরাই হলো গাফেল। (সুরা আল আরাফ : ১৭৯)।
নিঃসন্দেহে মানুষের মনোদৈহিক সুস্থতার জন্যে ইসলাম ধর্মে রয়েছে পরিপূর্ণ এবং যথার্থ দিক-নির্দেশনা। আধুনিক গবেষণাতেও দেখা গেছে জ্ঞানীগুণীরা বলতে বাধ্য হয়েছেন যে ধর্মীয় আচার আচরণ, নৈতিকতা এবং বোধ ও বিশ্বাসের সাথে মানুষের মনোদৈহিক সুস্থতার সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে এমন সব হুকুম আহকাম এবং নীতিমালা রয়েছে যেগুলো মানুষের আত্মার প্রশান্তি নিশ্চিত করে এবং শারীরিক সুস্থতাও বজায় রাখে।
মানুষ হলো দেহ ও আত্মার সমন্বিত রূপ। দেহ হলো বাহ্যিক দিক, যা চোখে দেখা যায়, হাতে স্পর্শ করা যায়। মানুষের অপর রূপটি হলো ভেতরে। তাকে নফস বা আত্মা বলা হয়। নফস বা আত্মাকে একমাত্র বিবেক দ্বারাই উপলব্ধি করা যায়। আর মানুষের বিবেক হচ্ছে এমন এক প্রকার মানসিক শক্তি যা মানুষকে সৎ কাজের প্রেরণা দেয়। কোনো মানুষ যখন নিয়মিতভাবে ভালো কাজ করতে থাকে, তখন তা তার চরিত্রের নৈতিক মূল্যকে বাড়িয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, মানুষের জীবনে উত্তম চর্চা যত বেশি করা হবে, ততই তিনি নৈতিক আদর্শের উচ্চ শিখরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। অর্থাৎ, নৈতিকতা হলো নিয়মিত চর্চার বিষয়। এক মুহূর্তও এর বিপরীত চর্চা করা যাবে না। ব্যক্তি পর্যায় থেকে পারিবারিক, সামাজিক এবং জাতীয় পর্যায়ের সব ক্ষেত্রে নৈতিকতা দেখাতে পারলে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি অবশ্যই এর দ্বারা প্রভাবিত হবে। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজমান থাকবে।
মানুষের সম্মান ও মর্যাদা নৈতিকতা অর্জনের ওপর নির্ভরশীল। অনৈতিক কাজকর্ম মানুষকে মনুষ্যত্বের স্তর থেকে পশুত্বের স্তরে নামিয়ে দেয়। মানবজীবনকে সুশৃঙ্খল করতে, মানুষের বিবেক-বুদ্ধি জাগ্রত করতে এবং মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের জন্য যে শিক্ষার প্রয়োজন সেটি হলো নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষার পরশে যাদের জীবন পরিচালিত হয়, তারাই আপন গন্তব্যে সহজেই পৌঁছে যেতে পারে। প্রিয় নবীজি (সা.) এর ওপর সর্বপ্রথম ‘ইকরা’ শব্দের মাধ্যমে ওহি নাজিল হয়েছিল।
‘ইকরা’ অর্থ পড়। পড়লেই মানুষ অজানাকে জানতে পারে, এ জন্য বলা হয়ে থাকে ‘জ্ঞানই শক্তি’। জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত সম্মান ও মর্যাদা। রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ (ইবনে মাজাহ : ২২০)। আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছ এবং যাদের ইলম দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদায় উন্নত করবেন। (সুরা মুজাদালাহ : ১১)
আল্লাহতায়ালা ওহির মাধ্যমে যে শিক্ষা দিয়েছেন এবং মানুষ তাদের অর্জিত জ্ঞান ও বুদ্ধি প্রয়োগ করে মানব কল্যাণমুখী যা অর্জন করেছে, এর সবই নৈতিক শিক্ষার আবরণে হয়েছে। কেননা মানুষ কিন্তু একসময় কিছুই জানত না। আল্লাহতায়ালাই তাকে ইলম শিক্ষা দিয়ে উচ্চ মর্যাদার আসনে স্থান দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, আর আল্লাহ তোমাদের নির্গত করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমন অবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতে না এবং তিনি তোমাদের দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং হৃদয়, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সুরা আননাহল : ৭৮)।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ৯২ বার শিক্ষার কথা বলেছেন। বর্তমান সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় আমরা যতটুকু এগিয়েছি, দুঃখজনক হলেও সততা, ন্যায়নীতি এবং নৈতিকতার উন্নয়নে আমরা ততদূর এগিয়েছি বলে মনে হয় না। বরং নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি দিন দিন। যেখানে মানবিকতা ও ন্যায়নীতি ক্রমেই লোপ পেতে চলেছে। শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে যে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষের নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ। চতুর্দিকে ভোগবাদী মানসিকতা তৈরি হয়েছে। এই মানসিকতা নষ্ট করে ফেলেছে অতীতের অনেক অর্জনকে। মানুষের সম্ভাবনাময় সুন্দর ভবিষ্যতও হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। সবাই পার্থিব ভোগবাদী মানসিকতা ও বৈসয়িক সম্পদের পেছনে হন্যে হয়ে ছুটছে। জাগতিক ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য ন্যায়-অন্যায়ের ভ্রুক্ষেপ করছে না। মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এক অশুভ প্রতিযোগিতা। কে কাকে কীভাবে কোণঠাসা করবে, কে কাকে মাড়িয়ে বড়লোক হবে, সেই প্রতিযোগিতা চলছে দুর্বার গতিতে। সভ্যতার ইতিহাস সৃষ্টির জন্য নয়, ধ্বংস আর বিনাশের দিকেই নজর অধিকাংশ মানুষের। এর স্বাভাবিক পরিণতি হলো নৈতিকতার অবক্ষয়। পৃথিবীর নানা প্রান্তে, দেশে দেশে মানবতা বিবর্জিত ও নীতি-নৈতিকতাহীন মানসিকতা পোষণকারী জনগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড ভাবিয়ে তুলেছে মানুষকে।
দেশে ভয়াবহ ব্যাধির মত দানা বাঁধছে নৈতিক ও সামজিক অবক্ষয়। সমাজ বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এখন থেকে এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আগামী বছরগুলোতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভয়াবহ রূপ নেবে সামাজিক অবক্ষয়। প্রতিদিন একটু একটু করে অবক্ষয়ের অতল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে দেশ। ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা সর্বক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি হয়ে উঠছে। শিক্ষার সর্বস্তরে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানো দরকার। তাহলে হয়তো আমরা সভ্য জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো।
এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হলো নৈতিক চরিত্রে চরিত্রবান একটি জাতি গঠন করা। অর্থাৎ, দেশপ্রেমিক, যোগ্য ও সুনাগরিক হিসেবে আমাদের শিক্ষার্থী এবং শিশুদের গড়ে তোলা, যাতে করে তারা নৈতিক চরিত্রে চরিত্রবান হয়ে দেশ গড়ার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।